রহমত নিউজ ডেস্ক 20 July, 2023 08:41 AM
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রেকর্ড ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, এই নিয়ে গত সাড়ে ছয় মাসে ১৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশে বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে এতো মৃত্যু হয়নি। এই সময়ে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৭৯২ জন। আর আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৫ হাজার ৭৯২ জন।
বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আর এই রোগের ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার পরেও সেদিকে নজর না দেয়ায় এই বছরে ডেঙ্গু মারাত্মক হয়ে উঠেছে বলে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করছেন। তারা বলছেন, এক সময়ে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগটি মৌসুমি রোগ বলে মনে করা হলেও, গত কয়েক বছর ধরে সারা বছর জুড়ে প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। এর ফলে এই রোগের চার ধরনের ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং রোগটি দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেনো এতো মারাত্মক হয়ে উঠলো?
বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। তখন এই রোগটি ঢাকা ফিভার নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে রোগটির সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে চললেও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে এই বছরে মৌসুমের আগে আগে সেটা প্রকট হয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি অবনতি হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন বলছেন, আসলে গত বছরের সঙ্গে এই বছরের মধ্যে ডেঙ্গু রোগী আসার ক্ষেত্রে কোন বিরতি ছিল না। শীতকালেও আমরা রোগী পেয়েছি। এবার মৌসুম শুরু হওয়ার এক দেড় মাস আগে থেকেই আমরা অনেক বেশি রোগী পাচ্ছি। আক্রান্তদের মধ্যে ডেঙ্গুর চারটি ধরন বা সেরোটাইপ পাওয়া যাচ্ছে। যারা এখন আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে দ্বিতীয় বার আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাই বেশি। ২০০০ সালের আগে আগে আমরা দেখেছি, মানুষজন একটা ডেঙ্গুর একটা ধরনে আক্রান্ত হতো। ফলে তাদের মধ্যে একটা প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠতো। কিন্তু যখন মানুষ চারটা ধরনেই আক্রান্ত হতে শুরু করে, তখন প্রতিরোধ ক্ষমতা তেমন কাজ করে না। তখন সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তিনগুণ বেড়ে যায়।
সোমবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. রাশেদা সুলতানা বলেছেন, দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। তবে প্রতিটি হাসপাতালেই এখন ডেঙ্গু কর্নার আছে। প্রতিটি হাসপাতালেই পর্যাপ্ত শয্যা প্রস্তুত রয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও আমরা চিকিৎসা দিতে প্রস্তুত আছি।
বাংলাদেশে গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৬২ হাজার ৩৮২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। মৃত্যু হয়েছিল রেকর্ড ২৮১ জনের। সেই বছরেও জুলাই, অগাস্ট মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তার আগের বছরেও ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক ছিল। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল ২০১৯ সালে। গত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর এরকম সংক্রমণ চলার পরেও সেটা ঠেকাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকর কোন ব্যবস্থা কেন নেয়া হয়নি?
এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মুশতাক হোসেন বলছেন, ডেঙ্গু মোকাবেলায় যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, সেটা অনেকটা গতানুগতিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এটা হয়তো সাময়িক একটা রোগ, কিছুদিন পরেই চলে যাবে। ফলে কার্যকর বা দীর্ঘমেয়াদি কোন ব্যবস্থা কোথাও নেয়া হচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গু রোগটা একেবারে জাঁকিয়ে বসেছে। যে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার, সেটা হচ্ছে না। এটা যে একটা মহামারী, সেরকম করে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। সেই সঙ্গে এডিস মশার ঘনত্ব বেড়ে গেছে। শহরে গ্রামে পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতলের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া পানি জমে যাওয়া, নগরায়নের ফলে পানি আটকে থাকার কারণে ডেঙ্গু মশা বেড়েছে, ফলে রোগীও বেড়ে গেছে।‘
স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগটি নিয়ে বড় ধরনের গবেষণা, নজরদারি নেই। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের তথ্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে আসছে। কিন্তু এর বাইরেও যে বিপুল মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের তথ্য কোথাও নেই। মশা দমনেও দেশ জুড়ে বড় ধরনের কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এমনকি এখন মশা দমনে যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোর কার্যকারিতা আছে কিনা, তাও কারও জানা নেই।
মৌসুমের আগেই ডেঙ্গু ভয়াবহ হয়ে উঠেছে
বাংলাদেশে বছরের প্রথম ছয় মাসেই ডেঙ্গু পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ড. মুশতাক হোসেন বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেক আগেই এসেছে। এটা এখন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে, ফলে এটাকে প্রাদুর্ভাব থেকে মহামারীর দিকে চলে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, এখন দেশে একটা জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। এটা মোকাবেলায় গতানুগতিক পদক্ষেপ বাদ দিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা নেয়া দরকার বলে তিনি মনে করছেন। না হলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না। বর্তমানে ঢাকার সবগুলো সরকারি হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার বেশি ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও এখন প্রতিদিন যত রোগী ভর্তি হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই ডেঙ্গু আক্রান্ত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলাতেই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। দেশে যে সময়কালকে ডেঙ্গুর মৌসুম বলে ধরা হয়, তার আগেই আক্রান্তের সংখ্যা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তদের বেশিরভাগই ঢাকা শহরের বাসিন্দা।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগ নিয়ে ভর্তি হয়েছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি বলছেন, তিনদিন আগে জ্বর এসেছিল। এরপর বমি শুরু হওয়ায় হাসপাতালে এসে ডাক্তার দেখালে ভর্তি হতে বলে। আমার আশেপাশে আরও যারা রয়েছে, তারা সবাই ডেঙ্গু রোগী। বেশিরভাগ রোগীকে হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে।
রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বরিশাল, যশোর, বগুড়ায় খবর নিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত নতুন নতুন রোগী ভর্তির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলছেন, ‘’ঢাকার বাইরে অধিকাংশ মানুষ প্রথমবারের মতো আক্রান্ত হচ্ছে, ফলে খুবই খারাপ ধরনের রোগীর সংখ্যা শহরের তুলনায় বা ঢাকার তুলনায় কম। তবে গত দুই বছরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কিন্তু এভাবে যদি ডেঙ্গু ছড়াতে থাকে, তাহলে আগামীতে আমরা গ্রামাঞ্চলেও আরও খারাপ পরিস্থিতি দেখতে পাবো। কারণ আগামীকে গ্রামাঞ্চলে মানুষজন দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হবে। তখন সেখানেও পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।‘’
শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীতেই সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে এখন ৫৩টি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। সবচেয়ে বেশি রোগী রয়েছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এসএসএসএমসি ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল, বেসরকারি হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে অনেক রোগী ভর্তি রয়েছে। বড় হাসপাতালগুলোয় জায়গা না হওয়ায় অনেক রোগী মেঝেতে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে তথ্য দেয়া হয়, তাতে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত তথ্য আসছে না বলে খোদ কর্মকর্তারাই স্বীকার করেছেন। কারণ যারা আক্রান্ত হয়ে ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের তথ্য এখানে যুক্ত হয়না। এমনকি সব বেসরকারি হাসপাতালের তথ্যও এখানে নেই। গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি সেমিনারে বক্তারা বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে এখন বিশেষ স্বাস্থ্য পরিস্থিতি হিসাবে ঘোষণা করার সময় এসেছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, আশঙ্কাজনকভাবে ডেঙ্গু রোগী বাড়লেও এখনো বিশেষ পরিস্থিতি ঘোষণা করার মতো সময় এসেছে বলে তারা মনে করেন না।
ডেঙ্গু হলে কখন হাসপাতালে যেতে হবে
চিকিৎসকরা বলছেন, বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় দেহে জ্বর দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। এরপর পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হলে রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসক ওষুধ বা হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেবেন। ডা. তৌফিক আহমেদ বলছেন, সব ধরনের ডেঙ্গুতেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না। সাধারণ জ্বরের সাথে অন্য কোন উপসর্গ না থাকলে বাড়িতে বিশ্রামে থেকে আর ওষুধ খেয়েই সুস্থ হওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে নিজে নিজে ওষুধ না খেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খেতে হবে। তবে প্রচুর তরল খাবার, ডাবের পানি, লেবুর শরবত ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণ জ্বর। সাধারণত ৯৯ থেকে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠতে পারে। জ্বরের সঙ্গে শরীরে ব্যথা, মাথা ব্যথা, চামড়ায় র্যাশ বা ফুসকুড়ি ওঠা, চোখে ব্যথা দেখা দিতে পারে। রোগীর ডায়াবেটিস থাকলে, ডেঙ্গুর সঙ্গে সঙ্গে যদি পেটে ব্যথা বা বমি হয়, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি বা লিভারের সমস্যা, অন্তঃসত্ত্বা ইত্যাদি থাকলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়া ভালো। বিশেষ করে বমি বা খিঁচুনি হলে, নাক, মলদ্বার, মাড়ি দিয়ে বা প্রস্রাবের সাথে রক্তপাত হলে কোনরকম দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর কমে গেলেও অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। তাহলে পরবর্তীতে অনেক জটিলতার এড়ানো যেতে পারে।অনেক সময় রোগীর রক্তে প্লেটলেট কাউন্ট কমে গেলে বা রক্তপাত বেশি হলে রক্ত দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে রোগীর রক্তের গ্রুপের সম্ভাব্য রক্তদাতার খোঁজ বা যোগাযোগ করে রাখা যেতে পারে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা